আজকে বরেন্দ্র-এর সেরা মুসলিম স্থাপত্যের গল্প শোনাই। লোকভাষায় স্থাপত্যটি ‘৫০ টাকার মসজিদ’ নামে পরিচিত। নান্দনিক কারুকার্য ও অনন্য সৌন্দর্যের কারণে ১৯৯৯ সালে ছাপা হওয়া ৫০ টাকার নোটে মসজিদটি স্থান পায়। সেখান থেকেই এ নাম।

রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে মসজিদটির অবস্থান। আমবাগানের ভেতর দিয়ে ছবির মতো সড়ক। সেই সড়ক ধরে বাসে চড়ে যেতে হয়। যেতে যেতে নাকে হু হু করে প্রবেশ করবে পাকা আমের মিষ্টি ঘ্রাণ। এটি এক অন্যরকম আনন্দ। ৯৩০ হিজরিতে নির্মিত হয় এ মসজিদ। প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো এ স্থাপনা এখনো বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন হাজারও দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখরিত থাকে বাঘা মসজিদ এলাকা। হুসনী শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন শাহের পুত্র সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরত শাহ এটি নির্মাণ করেন। ১০ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির প্রধান আকর্ষণ অসাধারণ নান্দনিক কারুকার্য খচিত দেয়ালের ইট। আরেকটি মজার ব্যাপার হলো রাজশাহীর ঐতিহ্য ‘আম’কে ব্যবহার করা হয়েছে দেয়ালগাত্র অলংকরণের কাজে। প্রত্নতত্ত্বপিপাসুদের জন্য বাঘা মসজিদ শ্রেষ্ঠ স্থান। ইট ও পোড়ামাটির অলংকরণে সজ্জিত পুরোনো এ মসজিদটি যে কারো চোখ জোড়ায়। মসজিদের চার কোণে চারটি বিরাট আকারের অষ্টাকোণাকৃতির কারুকার্য খচিত বুরুজ (টারেট) রয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ঐতিহাসিক স্থাপনার মতো এটিতেও ফারসি স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব রয়েছে। মাঝখানের দরজার ওপর ফার্সি ভাষায় লেখা একটি শিলালিপি রয়েছে। বাঘা শাহী মসজিদটি সম্পূর্ণ পোড়ামাটির ইট দিয়ে তৈরি করা। ইটগুলোর গাঁথুনি হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে চুন সুরকি। প্রায় সবখানেই রয়েছে টেরাকোটার নকশা। এটিকে বরেন্দ্র অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ মুসলিম ইমারত বলা হয়। প্রায় ২২.৯২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১২.৭৮ মিটার প্রস্থের আয়তাকার এ মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে আছে কারুকার্য খচিত চারটি মিহরাব। মিহরাবের দু’পাশে ও ওপরের ফ্রেমে নানা রকম লতাপাতা ও ফুলের প্রতিকৃতি অঙ্কিত। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে নারীদের নামাজের স্থান। বাঘা মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে উঁচু ভিটিতে নির্মিত অতিরিক্ত নামাজ কক্ষ রয়েছে।

ধারণা করা হয়, এ কক্ষটি শুধু সুলতানের প্রতিনিধি হিসাবে কর্মরত গভর্নরের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। এ ধরনের বিশেষ নামাজ কক্ষ বাংলার আর কোনো মসজিদে দেখা যায়নি। ইসলামের প্রাথমিক যুগের মসজিদগুলোতে খলিফার নিরাপত্তার জন্য এ ধরনের কক্ষ নির্মাণ করা হতো। ২০০৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বাঘা মসজিদে কিছু সংস্কার কাজ করে। সেখানে তারা আগের নকশা প্রতিস্থাপন করেছিল। আর এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন সিরাজগঞ্জের টেরাকোটা শিল্পী মদন পাল। এটি বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক অনন্য নজির। মদন পাল এতটা যত্নসহকারে কাজ করেছিলেন, যারা আগের নকশা দেখেননি, মদন পালের নকশার সঙ্গে আগের নকশার পার্থক্য তারা বুঝতে পারবেন না। বাঘা মসজিদ আমাদের দেশের ঐতিহ্য। মুসলিম স্থাপত্যের সৌন্দর্যের সাক্ষী। কিন্তু অবহেলার কারণে আজ এ স্থাপনা হারানোর পথে। দায়িত্বশীলরা উদ্যোগ নিলে আবারও মসজিদসহ পুরো বাঘানগরী তার হারানো জৌলুস ফিরে পাবে এবং পর্যটক ও দর্শনার্থীদের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব বিভাগেরও উন্নয়ন হবে।